বৃহস্পতিবার, ১৩ চৈত্র, ১৪৩১ | ২৭ মার্চ, ২০২৫ | রাত ৩:৫৪

নাগরিক সনদ ও আমরা

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১(১) এবং ২১(২)—এ নাগরিকদের কর্তব্য ও সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব নিয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। একদিকে বলা হয়েছে, আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং জাতীয় সম্পদ রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। অন্যদিকে, জনগণের সেবা করা সরকারি কর্মচারীদের প্রধান দায়িত্ব।

বিশ্বজুড়ে সুশাসন অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে স্বীকৃত। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সংবেদনশীলতার উপস্থিতি প্রয়োজন। আর এই লক্ষ্যেই নাগরিক সনদের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিক সনদ আসলে কী?

এটি হলো এমন একটি প্রতিশ্রুতি, যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের প্রতি সেবার ধরণ, মান ও প্রাপ্তির উপায় সম্পর্কে স্পষ্ট বিবরণ প্রদান করা হয়।

ব্রিটেন থেকে নাগরিক সনদের যাত্রা

১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্যে নাগরিক সনদের ধারণাটি চালু হয়। স্লোগান ছিল ‘সেবাই প্রথম’ (Service First), যার লক্ষ্য ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন। ছয়টি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে এই নাগরিক সনদের ধারণা তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। মূলনীতিগুলো হচ্ছে— সেবার মানোন্নয়ন; জনগণের চাহিদাকে অগ্রাধিকার; প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা প্রদান; করদাতাদের সম্মান; প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা।

পরবর্তীতে এগুলো আরও বিস্তৃত করা হয়, যেখানে সেবা পাওয়ার প্রতিটি ধাপ জনগণের কাছে উন্মুক্ত থাকে।

রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। সুতরাং জনগণের সঙ্গে লুকোচুরির কোনও সুযোগ নেই। সব তথ্যই জনগণের জানার অধিকার আছে এবং তাদেরকে জানতে দিতে হবে। তথ্য প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। প্রয়োজনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং তাদের থেকে পরামর্শ নিতে হবে, যাতে কার্যকরভাবে সেবা প্রদান সম্ভব হয়। এমনকি সাধারণ মানুষকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সেবা প্রদান করতে সম্মত থাকতে হবে এবং তাদেরকে সেবা গ্রহণে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। ভেদাভেদ ভুলে সব পেশা ও শ্রেণির মানুষকে সমান সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে সেগুলোতে তাদেরকে সেবা সংক্রান্ত সঠিক নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারের সর্বক্ষেত্রে সাশ্রয়ী মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে এবং নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে জনগণকে সেবা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশে নাগরিক সনদের বাস্তবতা

মজার ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা, বিশেষ করে রাজনীতিক ও আমলারা জনগণকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবাদানের বিষয়টি আমলেই নেন না। উপরন্তু আইসিটি আইন ও সু-কৌশলে ডাটা সুরক্ষা আইন তৈরি করে সরকার বাহাদুর জনগণের কথা বলা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করেছেন। সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকরা তাদের মত প্রকাশ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ডাটা সুরক্ষা আইন খসড়া তৈরি করা হয়েছিল এবং মন্ত্রিসভায় খসড়াটি অনুমোদিতও হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পতিত স্বৈরাচারী সরকারকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, যদি ডাটা সুরক্ষা আইন সংসদে পাস হয় এবং বাস্তবায়িত হয় তাহলে প্রায় দুই হাজার মার্কিন কোম্পানি (অনলাইন প্ল্যাটফর্ম) তাদের ব্যবসা বাংলাদেশ থেকে গুটিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

আমাদের দেশে এই নাগরিক সনদের ধারণাটি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। প্রচারণা থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব প্রকট। দুর্নীতি, ঘুষ ও অদক্ষ প্রশাসন এই ঘাটতির প্রধান কারণ। সরকারি দফতরগুলোতে ফাইল নড়তে ঘুষ লাগে, আর সেবা পেতে হয় ভোগান্তির শিকার।

আইসিটি আইন ও ডাটা সুরক্ষা আইনের মতো আইনগুলো কখনও কখনও নাগরিক অধিকার হরণের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের মতামতও প্রমাণ করে যে, এ ধরনের আইন দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

সমাধান কোথায়?

নাগরিক সনদের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন জনগণ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ, স্পষ্ট সেবা মান ও অধিকার সম্পর্কে প্রচারণা, সেবা প্রদান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং কঠোর আইন প্রণয়ন। প্রশাসন সংস্কার কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে জনগণের অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতার ওপর।

নাগরিক সনদ শুধু একটি নীতিমালা নয়, এটি জনগণের অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে সেতুবন্ধ। ঘুষ, দুর্নীতি ও অদক্ষতার জালে আটকে না থেকে আমাদের এখনই সময় এগিয়ে যাওয়ার। হাবিব ওয়াহিদের গানের কথা মনে করিয়ে দেয়— ‘সেই স্বপ্ন আকাশ ছোঁবার, কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দেবার, এখনই সময় বন্ধু!’

সুতরাং, এখনই সময় নাগরিক সনদের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার।

লেখক: সাবেক পুলিশ সুপার।

ট্যাগ :

সর্বশেষ প্রকাশিত

ইউটিউবে যুক্ত হোন

সম্পাদক:

কপিরাইট ২০২৫ | ফাইন্ডিং পলিটিক্স