শনিবার, ৮ চৈত্র, ১৪৩১ | ২২ মার্চ, ২০২৫ | রাত ১২:৪৯

তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে…

মহাভারতের এই বিখ্যাত প্রবাদ চিরন্তন সত্যকে প্রতিফলিত করে। গল্পে রাজা কংস জানতে পারে তার ভাগ্নে কৃষ্ণই তাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করবে। ভয়ে কংস তার বোন দেবকী ও ভগ্নিপতি বাসুদেবকে বন্দি করে। কিন্তু কারারক্ষীদের সহানুভূতিতে কৃষ্ণের জন্ম হয় এবং তাকে গোকুলে লালন-পালনের জন্য পাঠানো হয়। বড় হয়ে কৃষ্ণ কংসকে পরাজিত করে রাজ্য উদ্ধার করেন।

এই গল্প আমাদের শেখায়, অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, ন্যায় ও সত্যের পথে এগিয়ে চলার শক্তি কোনোদিন দমে না। মহাভারতের এ শিক্ষা যেন ইতিহাসেও প্রতিফলিত হয়েছে, বিশেষত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ায়।

সিমলা চুক্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করতে চায়। কিন্তু ১৯৭২ সালে ভারতের হিমাচল প্রদেশে অনুষ্ঠিত সিমলা চুক্তিতে বাংলাদেশের দাবি উপেক্ষিত হয়। চুক্তির পর পাকিস্তান কূটনৈতিক চাল দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ কঠিন করে তোলে। ভারত ও চীনের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সমর্থনে পাকিস্তান এই বিচার এড়িয়ে যায়।

তবে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকেনি। ১৯৭৩ সালে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন’ প্রণীত হয়। এই আইন যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে এই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে।

জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনে যুদ্ধাপরাধীরা রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে। জেনারেল এরশাদের সময় জামায়াতে ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধী সংশ্লিষ্ট দল রাজনীতিতে জায়গা পায়। এর মধ্যেও জনগণের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি অব্যাহত ছিল।

গণজাগরণ মঞ্চ ও শাহবাগ আন্দোলন

২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ জোরদার করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় এবং প্রথম পর্যায়ে কয়েকজন প্রভাবশালী অপরাধীর বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা ঘোষিত হলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এরই ফলশ্রুতিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠে। কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। শাহবাগে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন থেকে শুরু করে একাধিক কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের চাপে সরকার আইনে পরিবর্তন এনে কাদের মোল্লার সাজা মৃত্যুদণ্ডে রূপান্তর করে।

গণজাগরণ মঞ্চ শুধু কাদের মোল্লার বিচারেই থেমে থাকেনি; এটি যুদ্ধাপরাধীদের সম্পূর্ণ বিচার সম্পন্ন করার দাবি তোলার শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে।

আইন ও বিচার নিয়ে বিতর্ক

যদিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জনমনে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে, তবুও বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে।

১. বিচারের স্বচ্ছতা: অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত না করায় অনেক সাক্ষীকে ভয় দেখানো বা পাচার করা হয়েছিল।

২. আইনগত সমস্যা: ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। বিশেষত, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৭ক(১)-এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের কিছু মৌলিক অধিকার সীমিত করা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়।

৩. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরাসরি সাক্ষ্যপ্রমাণের ঘাটতি রয়েছে।

খেলা জমবে

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের জন্য ন্যায়বিচার ও আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের অংশ। শেখ হাসিনার সরকারের নেতৃত্বে বিচার কার্যক্রম অনেকটাই এগিয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এখন সেই শেখ হাসিনার বিচার একই ট্রাইব্যুনালে হতে যাচ্ছে।

৩৬ জুলাই পর্যন্ত (জুলাই ও ৫ আগস্ট, ২০২৪) যে সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর বিচার ১৯৭৩ সালে প্রণীত এবং ২০১৩ সালে শেখ হাসিনার সরকার সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে করার জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন যে, প্রাথমিকভাবে ট্রাইবুনাল আইন সংশোধন করার প্রয়োজনীয়তা নাই। প্রয়োজনে সংশোধনী আনা হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৈরি করা আইনেই আপাতত তার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। মাসুদ সাঈদী যেমন বলেছেন, ‘ট্রাইব্যুনাল প্রস্তুত, খেলা শুরু হোক’। হয়তো খেলা জমবে!

লেখক: সাবেক পুলিশ সুপার

ট্যাগ :

সর্বশেষ প্রকাশিত

ইউটিউবে যুক্ত হোন

সম্পাদক:

কপিরাইট ২০২৫ | ফাইন্ডিং পলিটিক্স